চেকের মামলায় পলাতক আসামীর বিরুদ্ধে পত্রিকায় লিগ্যাল নোটিস দিয়ে মামলা করুন

বাংলাদেশের আইনব্যবস্থায় চেক বাউন্সের মামলা (Cheque Bounce Case) একটি সাধারণ কিন্তু জটিল আইনি বিষয়। অনেক সময় পলাতক আসামীর বিরুদ্ধে মামলা কার্যকর করতে গিয়ে লিগ্যাল নোটিস জারির পদ্ধতি নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হয়। এই প্রবন্ধে আমরা নেগোসিয়েবল ইন্সট্রুমেন্টস অ্যাক্ট (Negotiable Instruments Act, সংক্ষেপে এনআই অ্যাক্ট) এর ১৩৮ ধারার আলোকে চেকের মামলায় পলাতক আসামীর বিরুদ্ধে লিগ্যাল নোটিস কীভাবে এবং কোন পত্রিকায় প্রকাশ করতে হবে সে বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।

সূচিপত্র

পরিচিতিঃ লিগ্যাল নোটিস এবং চেকের মামলা

চেক বাউন্স বা চেক ডিসঅনার মামলায় লিগ্যাল নোটিস জারি করা একটি অপরিহার্য ধাপ। এনআই অ্যাক্টের ১৩৮ ধারা অনুযায়ী, চেক প্রদানে ব্যর্থতা বা চেক বাউন্সের ক্ষেত্রে দাবিদারকে (যিনি চেকের দাবিদার) তিন ধরণের পদ্ধতিতে লিগ্যাল নোটিস জারি করার সুযোগ রয়েছে। এগুলো হলো:

  1. প্রত্যক্ষভাবে আসামীর নিকট লিগ্যাল নোটিস দেওয়া এবং গ্রহণ করিয়ে নেওয়া।
  2. আসামীর ঠিকানায় রাষ্ট্রীয় ডাকযোগে রেজিস্টার্ড লিগ্যাল নোটিস পাঠানো।
  3. যদি আসামীর সঠিক ঠিকানা না জানা যায় বা আসামী পলাতক থাকে, তাহলে বহুল প্রচারিত বাংলা দৈনিক পত্রিকায় ওই লিগ্যাল নোটিস প্রকাশ করা।

এই তিন পদ্ধতির যে কোনও একটি পদ্ধতিতে নোটিশ জারি হলেই আইনগতভাবে যথেষ্ট। একাধিক পদ্ধতিতে নোটিশ জারি করার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।

বহুল প্রচারিত পত্রিকা: কোন পত্রিকায় নোটিশ প্রকাশ করবেন?

এনআই অ্যাক্টের ১৩৮(১) ধারা স্পষ্ট করে দেয়নি কোন পত্রিকাকে “বহুল প্রচারিত” হিসেবে গণ্য করা হবে। জাতীয় পত্রিকা নাকি স্থানীয় পত্রিকা, কোন ধরনের পত্রিকায় নোটিশ প্রকাশ করলে সেটি বৈধ হবে, সে বিষয়ে আইনগত কোনো স্পষ্ট নির্দেশনা নেই।

একটি মামলায় অপেক্ষাকৃত কম প্রচারিত পত্রিকায় নোটিশ প্রকাশের বিষয়টি আসামী পক্ষ চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে মামলা দায়ের করেছিল। আদালত এই বিষয়ে মত দিয়েছেন যে, কোন পত্রিকা বহুল প্রচারিত কিনা, জাতীয় পত্রিকা কিনা তা নির্ণয় করতে হবে সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে এবং তা বিচারিক আদালত কর্তৃক নির্ধারণযোগ্য। শুধুমাত্র “বহুল প্রচারিত পত্রিকায় নোটিশ প্রকাশ করা হয়নি” এই টেকনিক্যাল অজুহাতে মামলা কোয়াশ করা যাবে না।

বাংলাদেশের উচ্চ আদালতের বিভিন্ন সিদ্ধান্তে বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে। যেমন:

  • ৬৮ ডিএলআর ২২৫ পৃষ্ঠায় উচ্চ আদালত উল্লেখ করেছেন যে, পত্রিকার জাতীয়তা বা প্রচারিত হওয়ার বিষয়টি বিচারিক আদালতের সিদ্ধান্তের বিষয়।
  • ৬৯ ডিএলআর ৩৬৩ পৃষ্ঠায় হাইকোর্ট বিভাগ উল্লেখ করেছেন জাতীয় পত্রিকা এবং বহুল প্রচারিত পত্রিকার অর্থ কী, তা নিয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা রয়েছে।
  • ৭১ ডিএলআর ৪৫৮ পৃষ্ঠায় হাইকোর্ট বিভাগের ডিভিশন বেঞ্চ বলেছে, স্থানীয় পত্রিকায় নোটিশ প্রকাশ করা হলেও তা বৈধ বলে গণ্য হবে।
  • ৩৯ বিএলডি ৪০৩ পৃষ্ঠায় উচ্চ আদালত আবারও নিশ্চিত করেছে যে স্থানীয় পত্রিকায় নোটিশ প্রকাশের মাধ্যমে আইনগত বাধ্যবাধকতা পূরণ হয়।

নোটিশ জারির বৈধতা এবং প্রয়োজনীয়তা

কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, রেজিস্টার্ড ডাকযোগে লিগ্যাল নোটিশ পাঠানোর পর আবার দৈনিক পত্রিকায় নোটিশ প্রকাশ করার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। এই বিষয়ে আদালতের স্পষ্ট মতামত আছে যে, রেজিস্টার্ড ডাকযোগে নোটিশ পাঠানোর পর অতিরিক্তভাবে পত্রিকায় নোটিশ প্রকাশ করা বাধ্যতামূলক নয়।

অর্থাৎ, এনআই অ্যাক্টের ১৩৮ ধারায় বর্ণিত যেকোন একটি পদ্ধতিতে নোটিশ জারি হলেই যথেষ্ট। একাধিক পদ্ধতিতে একই নোটিশ জারি করার প্রয়োজন নেই। এটি মামলার প্রক্রিয়া দ্রুততর করে এবং অনাবশ্যক আইনি ঝামেলা থেকে রক্ষা করে।

চেক মামলায় লিগ্যাল নোটিস জারি করার প্রক্রিয়া

চেক বাউন্সের মামলায় লিগ্যাল নোটিস জারি করার সময় নিম্নলিখিত বিষয়গুলো বিবেচনা করতে হবে:

  1. নোটিশের ভাষা ও বিষয়বস্তু: নোটিশ অবশ্যই স্পষ্ট ও আইনি ভাষায় হওয়া উচিত, যাতে আসামী বুঝতে পারে যে তাকে কী দাবি করা হচ্ছে এবং কত দিনের মধ্যে প্রতিক্রিয়া জানাতে হবে।
  2. আসামীর সঠিক ঠিকানা নির্ণয়: যদি আসামী পলাতক থাকে বা ঠিকানা অজানা হয়, তাহলে পত্রিকায় নোটিশ প্রকাশ করাই একমাত্র বিকল্প।
  3. বহুল প্রচারিত পত্রিকা নির্বাচন: স্থানীয় পত্রিকাও বৈধ হতে পারে, তবে অধিক পরিচিত ও প্রচারিত পত্রিকায় প্রকাশ করাই অধিক কার্যকর।
  4. নোটিশের সময়সীমা: এনআই অ্যাক্টে নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে নোটিশ দিতে বলা হয়েছে, তাই সময়মতো নোটিশ প্রদান অপরিহার্য।
  5. আইনগত পরামর্শ গ্রহণ: নোটিশ জারি করার পূর্বে অভিজ্ঞ আইনজীবীর পরামর্শ নেওয়া উচিত যাতে আইনি ত্রুটি এড়ানো যায়।

আইনগত সিদ্ধান্ত ও মামলার প্রভাব

বাংলাদেশের উচ্চ আদালতের বিভিন্ন রায় থেকে স্পষ্ট হয় যে, পত্রিকায় নোটিশ প্রকাশের ক্ষেত্রে আইনি জটিলতা দূরীকরণে আদালত যথেষ্ট নমনীয়। নোটিশ প্রকাশ না করার বা কম প্রচারিত পত্রিকায় প্রকাশ করার কারণে মামলার অবস্থা খারাপ হবে এমন ধারণা ভুল। আদালত সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং শুধুমাত্র টেকনিক্যাল অজুহাতে মামলা কোয়াশ করাকে সমর্থন করে না।

এছাড়া, পত্রিকায় নোটিশ প্রকাশের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আদালত পরামর্শ দিয়েছেন যে, রেজিস্টার্ড ডাকযোগে নোটিশ পাঠানো হলে পুনরায় পত্রিকায় নোটিশ প্রকাশ করার প্রয়োজন নেই। এই সিদ্ধান্ত মামলার কার্যকারিতা বাড়াতে সহায়ক।

সারসংক্ষেপ

চেকের মামলায় আসামীর বিরুদ্ধে লিগ্যাল নোটিস জারি একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। এনআই অ্যাক্টের ১৩৮ ধারায় বর্ণিত তিনটি পদ্ধতির যে কোনও একটি অনুসরণ করলেই যথেষ্ট। পত্রিকায় নোটিশ প্রকাশের ক্ষেত্রে “বহুল প্রচারিত পত্রিকা” নির্ধারণে আইন স্পষ্ট নয়, তবে উচ্চ আদালত স্থানীয় পত্রিকায় প্রকাশকেও বৈধ বলে গণ্য করেছেন।

নোটিশ জারির ক্ষেত্রে টেকনিক্যাল ভুল বা অপ্রচলিত পত্রিকায় নোটিশ প্রকাশের কারণে মামলা স্থগিত বা খারিজ হবে না। রেজিস্টার্ড ডাকযোগে নোটিশ পাঠানোর পর পত্রিকায় পুনরায় নোটিশ প্রকাশের প্রয়োজন নেই।

এই তথ্যগুলো চেকের মামলায় লিগ্যাল নোটিস সংক্রান্ত যে কোনও বিতর্ক দূর করবে বলে আশা করা যায়। আইনি পরামর্শের জন্য অভিজ্ঞ আইনজীবীর সঙ্গে যোগাযোগ করা সর্বদা উত্তম।

প্রশ্নোত্তর (FAQ)

১. চেকের মামলায় লিগ্যাল নোটিস জারি করার কোন পদ্ধতি গৃহীত হবে?

আইন অনুযায়ী, তিনটি পদ্ধতির যে কোন একটি পদ্ধতিতে লিগ্যাল নোটিস জারি করা যেতে পারে – প্রত্যক্ষ নোটিস প্রদান, রেজিস্টার্ড ডাকযোগে নোটিস পাঠানো বা বহুল প্রচারিত পত্রিকায় নোটিস প্রকাশ।

২. বহুল প্রচারিত পত্রিকা বলতে কী বোঝায়?

আইনে স্পষ্ট সংজ্ঞা না থাকলেও, আদালত সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত দেয় কোন পত্রিকা বহুল প্রচারিত বা জাতীয় পত্রিকা হিসেবে গণ্য হবে। স্থানীয় পত্রিকাও বৈধ হতে পারে।

৩. রেজিস্টার্ড ডাকযোগে নোটিস পাঠানোর পর পত্রিকায় আবার নোটিস প্রকাশ করা কি বাধ্যতামূলক?

না, একবার রেজিস্টার্ড ডাকযোগে নোটিস পাঠানো হলে অতিরিক্তভাবে পত্রিকায় নোটিস প্রকাশ করা বাধ্যতামূলক নয়।

৪. যদি আসামী পলাতক থাকে, তাহলে কীভাবে নোটিস জারি করা যাবে?

পলাতক আসামীর ক্ষেত্রে বহুল প্রচারিত পত্রিকায় লিগ্যাল নোটিস প্রকাশ করাই আইনসম্মত উপায়।

৫. একাধিক পদ্ধতিতে নোটিস জারি করা প্রয়োজন কি?

না, একাধিক পদ্ধতিতে একই নোটিস জারি করার প্রয়োজন নেই। যে কোন এক পদ্ধতি যথেষ্ট।

৬. নোটিস জারি না করলে কি চেক মামলা চলবে না?

না, আইন অনুযায়ী নোটিস জারি করা বাধ্যতামূলক, তবে সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করলে মামলা চলবে। টেকনিক্যাল ভুল থাকলে আদালত নরম হতে পারে।

উপসংহার

চেক বাউন্স মামলায় লিগ্যাল নোটিস জারি করার বিষয়টি আইনগতভাবে জটিল হলেও সঠিক জ্ঞান ও প্রক্রিয়া অনুসরণ করলে এটি সহজ হয়ে ওঠে। পলাতক আসামীর বিরুদ্ধে নোটিস পত্রিকায় প্রকাশের ক্ষেত্রে আদালতের বিরাট সহযোগিতা রয়েছে। এই প্রবন্ধের আলোকে আশা করা যায় যে, চেক মামলায় লিগ্যাল নোটিস সংক্রান্ত সকল বিতর্ক দূর হবে এবং আইনি প্রক্রিয়া আরো স্বচ্ছ ও কার্যকর হবে।

আইনি সহায়তার জন্য অভিজ্ঞ আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ করুন এবং সময়মতো যথাযথ নোটিস জারি করে আপনার আইনি অধিকার রক্ষা করুন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top