বাংলাদেশে বাড়ির মালিক এবং ভাড়াটিয়ার আইনি অধিকার ও দায়িত্ব নিয়ে অনেকেই বিভ্রান্তিতে থাকেন। ভাড়া নিয়ে দ্বন্দ হলে কখন মালিক ভাড়াটিয়াকে উচ্ছেদ করতে পারবেন, কখন পারবেন না, এবং উভয় পক্ষের আইনি প্রতিকার কী কী—এসব বিষয়ে সঠিক জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। এই নিবন্ধে আমি, পিএম সিরাজুল ইসলাম প্রামাণিক, আপনাদের জন্য বিস্তারিত আলোচনা করব মালিক-ভাড়াটিয়ার সম্পর্ক, আইনি অধিকার ও রেন্ট কোর্টের কার্যক্রম নিয়ে।
বাড়িভাড়া চুক্তি: আইনের ভিত্তি ও গুরুত্বপূর্ণ দিকসমূহ
বাড়ি, ফ্ল্যাট, দোকান, অফিস বা গুদাম ভাড়ার ক্ষেত্রে মালিক এবং ভাড়াটিয়ার মধ্যে অবশ্যই একটি লিখিত চুক্তিনামা থাকা আবশ্যক। মৌখিক চুক্তির কোন আইনি ভিত্তি নেই, তাই এর মাধ্যমে কোন পক্ষই আইনি প্রতিকার পেতে সক্ষম নয়।
ভাড়া চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত থাকা জরুরি বিষয়সমূহ:
- চুক্তির মেয়াদ নির্ধারণ
- মালিক ও ভাড়াটিয়ার নাম, ঠিকানা ও মোবাইল নম্বর
- মাসিক ভাড়ার পরিমাণ ও পরিশোধের নির্দিষ্ট তারিখ
- পানি সরবরাহ, বিদ্যুত বিল ও অন্যান্য সেবার চার্জ
- জামানতের পরিমাণ ও তার পরিশোধের পদ্ধতি
- চুক্তি নবায়ন বা মেয়াদ বৃদ্ধি সংক্রান্ত শর্তাবলী
এই চুক্তিপত্র অবশ্যই ৩০০ টাকার নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে লিখিত হতে হবে। প্রয়োজন হলে এটি রেজিস্ট্রি করানো যায় বা নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে নোটারাইজ করানো যেতে পারে। সম্পত্তি হস্তান্তর আইনের ১০৭ ধারার অধীনে রেজিস্ট্রি না হলে চুক্তি এক বছরের জন্য বৈধ বলে গণ্য হবে।
বাড়িওয়ালা ও ভাড়াটিয়ার দায়িত্ব ও অধিকার
নতুন বাসা বা অফিসে উঠার আগে বৈদ্যুতিক মিটার রিডিং, গ্যাস, গিজার, পানি মিটার, ময়লা ফেলা, দারোয়ান ইত্যাদি বিষয় মালিক এবং ভাড়াটিয়া উভয়েরই লিখে রাখা উচিত। এছাড়া আশেপাশের পরিবেশ সম্পর্কে মালিককে ভাড়াটিয়াকে অবহিত করার দায়িত্ব আছে।
মনে রাখতে হবে, ভাড়াটিয়া মালিকের কাছে জিম্মি নয়। মালিক মাসিক ভাড়ার বাইরে অন্য কোনো প্রিমিয়াম, সালামি বা অগ্রিম জামানত গ্রহণ করতে পারবেন না। যদি মালিক অগ্রিম জামানত গ্রহণ করেন, তাহলে ভাড়াটিয়া রেন্ট কোর্টে মামলা করতে পারেন এবং মালিক ভাড়াটিয়াকে উচ্ছেদের জন্য মামলা করতে পারবেন না।
কোনো কারণে মালিক ভাড়ার টাকা গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি দিলে ভাড়াটিয়া পোস্ট অফিসের মাধ্যমে মানি অর্ডার পাঠিয়ে ভাড়া জমা দিতে পারেন। মালিক যদি তা গ্রহণ না করেন, তাহলে পরবর্তী ১৫ দিনের মধ্যে রেন্ট কোর্টে দরখাস্ত করে টাকা জমা দিতে হবে।
মালিকের আইনি অধিকার ও উচ্ছেদ সংক্রান্ত নিয়মাবলী
যদি ভাড়াটিয়া নিয়মিত ভাড়া না দেন, তাহলে সম্পত্তি হস্তান্তর আইনের ১০৬ ও ১০৮ (গ) ধারার অধীনে মালিক উচ্ছেদের নোটিশ দিয়ে মামলা করতে পারেন।
মালিক প্রতি দুই বছর অন্তর যৌক্তিক ভিত্তিতে বাড়ির ভাড়া বৃদ্ধি করতে পারেন। তবে বাড়ির গঠনগত পরিবর্তন, সাবলেটিং বা পার্শ্ববর্তী বাড়ির অধিকার লঙ্ঘন করলে মালিক আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারেন।
চুক্তির মেয়াদ শেষ হলে মালিকের অনুমতি ছাড়া বাড়ির নকশা পরিবর্তন করলেও উচ্ছেদ করা যাবে। বাসাবাড়ী, দোকান, অফিস বা গুদাম মাসিক ভাড়ায় থাকলে মাত্র ১৫ দিনের নোটিশে উচ্ছেদ করা যায়। বার্ষিক ইজারা বা শিল্প কারখানায় ৬ মাসের নোটিশ প্রয়োজন।
রেন্ট কোর্ট ও আইনি প্রতিকার
১৯৯১ সালের ভাড়াটিয়া নিয়ন্ত্রণ আইনের অধীনে একজন সিনিয়র সহকারী জজ রেন্ট কোর্টের দায়িত্ব পালন করেন। এই আইনের ১২ নং ধারায় বলা হয়েছে, বাড়ি ভাড়ার সময় কোনো ব্যক্তি আসবাবপত্র ক্রয়ের শর্ত বা আসবাবপত্র আটক রাখতে পারবেন না। অর্থাৎ ভাড়াটিয়া নিয়মিত ভাড়া না দিলেও মালিক আসবাবপত্র আটকে রাখতে পারেন না।
ভাড়াটিয়া বা মালিক উভয়ই ভাড়া সংক্রান্ত কোন দ্বন্দ হলে রেন্ট কোর্টে মামলা দায়ের করে আইনি প্রতিকার পেতে পারেন। রেন্ট কোর্টের মাধ্যমে দ্রুত ও কার্যকর সমাধান সম্ভব।
সারসংক্ষেপ
- ভাড়া চুক্তি অবশ্যই লিখিত ও স্ট্যাম্পসহ হতে হবে, মৌখিক চুক্তির কোন আইনি গুরুত্ব নেই।
- ভাড়াটিয়া মাসিক ভাড়া ব্যতীত অন্য কোনো প্রিমিয়াম দিতে বাধ্য নয়।
- মালিক নিয়মিত ভাড়া না পেলে উচ্ছেদের জন্য আইনি পদক্ষেপ নিতে পারেন।
- রেন্ট কোর্টে উভয় পক্ষই দ্রুত আইনি প্রতিকার পেতে পারেন।
- ভাড়াটিয়ার আসবাবপত্র আটকানোর কোন আইনি অধিকার মালিকের নেই।
আইনি দ্বন্দ্ব এড়াতে এবং উভয় পক্ষের অধিকার সুরক্ষিত রাখতে ভাড়া চুক্তি সঠিকভাবে করা এবং নিয়মিত আইনি পরামর্শ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। আইনি সহায়তার জন্য আপনি প্রামাণিক আইনজীবীদের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন।
আপনারা যদি বাড়ি মালিক বা ভাড়াটিয়া হিসেবে আইনি প্রতিকার বা পরামর্শ চান, তাহলে অবশ্যই পেশাদার আইনজীবীর পরামর্শ নিন এবং রেন্ট কোর্টের সঠিক ব্যবস্থার মাধ্যমে আপনার অধিকার সুরক্ষিত করুন।